০২:২৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫, ৭ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুই পা নেই তবু অদম্য সনিয়া, মায়ের কোলে চড়ে নিলেন সেরা জয়িতার পুরস্কার

মায়ের কোলে চড়ে সেরা জয়িতার পুরস্কার গ্রহন করছেন অদম্য সনিয়া আক্তার। ছবি- ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস।

দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় হারিয়েছেন দুই পা। তখন বয়স মাত্র সাত থেকে আট বছর। পায়ের রক্তনালী বøক হয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় তীব্র ব্যথা, ফোলে যায় পা। অনেক হাসপাতাল ঘুরে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় অবশেষে চিকিৎসকের পরামর্শে কেটে ফেলে দিতে হয় দুই পা। তখন থেকেই শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন।

তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আটকে রাখতে পারেনি তাকে। তিনি হাঁটছেন জীবন জয়ের পথে। শত বাধা পেরিয়ে তিনি এগিয়েই চলেছেন বিজয়ীর বেশে। কথাগুলো বলা হচ্ছিল ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার ঈশ্বরগঞ্জ সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থী মোসা. সনিয়া আক্তারের (১৯)। অদম্য সনিয়ার সংগ্রামী জীবনের গল্প এটি। এবার বেগম রোকেয়া দিবসে শিক্ষা ও চাকুরী ক্যাটাগরিতে বিশেষ বিবেচনায় সেরা জয়িতার সম্মাননা পান সেই সনিয়া।

 

বুধবার মুঠোফোনে সনিয়ার মা শিউলি বেগম বলেন, ‘সনিয়াকে লইয়্যা(নিয়ে) আমি অনেক কষ্ট করছি জীবনে। পড়ালেখার প্রতি মেয়ের আগ্রহ দেখে আমি কোলে করে ক্লাসে নিয়ে যাই। এবার শিক্ষায় আমার মেয়ে সেরা জয়িতা নির্বাচিত হওয়ায় মনে হচ্ছে, আমার পরিশ্রম বৃথা যায়নি। সবাই আমার মেয়ের জন্য দোয়া করেবেন। এই কথাগুলো বলতে বলতেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন সনিয়ার মা।’

গত ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের আয়োজনে সনিয়ার হাতে শিক্ষা ও চাকুরী ক্যাটাগরিতে সেরা জয়িতার সম্মাননা পুরস্কার ও সনদ তোলে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সারমিনা সাত্তার ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ্জহুরা। এসময় বিভিন্ন রাজনৈতিকদল, ছাত্র-সুশীল সমাজসহ সকল শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।

সনিয়ার বাড়ি উপজেলার রাজিবপুর ইউনিয়নের উজান-চরনওপাড়া গ্রামে। কৃষক বাবা রইছ উদ্দিনের অভাব-অনটনের ঘরে জন্ম তার। দুই ভাই আর চার বোনের মধ্যে সনিয়া তৃতীয়।
অভাব, প্রতিকূলতা আর শত বঞ্চনার মাঝেই তার বেড়ে ওঠা। তবুও হাল ছাড়েননি সনিয়া।

হামাগুড়ি ও মায়ের কোলে চড়েই এগিয়ে চলেছে তার শিক্ষা জীবন। কৈশোরে মাইলের পর মাইল হেঁটে দূরের গ্রাম থেকে নিয়মিত স্কুলে আসতেন তিনি। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে এখন তিনি ঈশ্বরগঞ্জ সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। এর আগে উপজেলার উচাখিলা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও আলীনগর কারিগরি বাণিজ্যিক কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সনিয়া।

 

সনিয়া বলেন, ‘ছোট বেলা থেকেই আমার মা-বাবা কষ্ট করে আমাকে বড় করেছেন। আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন পায়ের রক্তনালীতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে ইনফেকশন হয়। আমার দুটি পা কেটে ফেলা হয়। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি, পড়াশোনা শেষ করে একটি চাকরি নিয়ে বাবা-মায়ের দুঃখ লাগব করে তাদের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই। শিক্ষা ক্যাটাগরিতে সেরা জয়িতা হতে পেরে খুব ভালো লাগছে। এই সম্মান আমাকে স্বপ পূরণের দিকে একধাপ এগিয়ে নিতে প্রেরণা যুগিয়েছে।

 

ঈশ্বরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. রফিকুল ইসলাম খান বলেন, সনিয়ার অদম্য আগ্রহ দেখে আমরা অভিভূত। আমাদের কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে এবার অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে মেয়েটি। রোকেয়া দিবসে সে সেরা জয়িতা নির্বাচিত হওয়ায় আমার শিক্ষক হিসেবে তাকে নিয়ে গর্ববোধ করছি। আমরা সনিয়ার উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করছি।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ্জহুরা বলেন, ‘শিক্ষার প্রতি অদম্য চেষ্টা ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে লেখাপড়া চালিয়ে নিতে জীবনে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে সনিয়াকে। তাই তাকে উৎসাহ দিতে শিক্ষা ও চাকুরী ক্যাটাগরিতে সেরা জয়িতা মনোনীত করে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।’

 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) সারমিনা সাত্তার বলেন, ‘প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল থেকে ওঠে আসা সনিয়া এখন অন্য শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা। মেয়েটার কতো আগ্রহ, দুটি পা না থাকা সত্ত্বেও স্নাতক পর্যন্ত লেখাপড়া করা সত্যিই অনেক কঠিন। কিন্তু সনিয়া তা পেরেছে, সে হতে পারে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের পরবর্তী দৃষ্টান্ত। তাকে সেরা জয়িতা নির্বাচিত করতে পেরে উপজেলা প্রশাসন এবং আমি নিজেও গর্ববোধ করছি।’

 

ট্যাগ :
অধিক পঠিত

দুই পা নেই তবু অদম্য সনিয়া, মায়ের কোলে চড়ে নিলেন সেরা জয়িতার পুরস্কার

পোষ্টের সময় : ০৩:৩৩:২৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় হারিয়েছেন দুই পা। তখন বয়স মাত্র সাত থেকে আট বছর। পায়ের রক্তনালী বøক হয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় তীব্র ব্যথা, ফোলে যায় পা। অনেক হাসপাতাল ঘুরে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় অবশেষে চিকিৎসকের পরামর্শে কেটে ফেলে দিতে হয় দুই পা। তখন থেকেই শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন।

তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আটকে রাখতে পারেনি তাকে। তিনি হাঁটছেন জীবন জয়ের পথে। শত বাধা পেরিয়ে তিনি এগিয়েই চলেছেন বিজয়ীর বেশে। কথাগুলো বলা হচ্ছিল ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার ঈশ্বরগঞ্জ সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থী মোসা. সনিয়া আক্তারের (১৯)। অদম্য সনিয়ার সংগ্রামী জীবনের গল্প এটি। এবার বেগম রোকেয়া দিবসে শিক্ষা ও চাকুরী ক্যাটাগরিতে বিশেষ বিবেচনায় সেরা জয়িতার সম্মাননা পান সেই সনিয়া।

 

বুধবার মুঠোফোনে সনিয়ার মা শিউলি বেগম বলেন, ‘সনিয়াকে লইয়্যা(নিয়ে) আমি অনেক কষ্ট করছি জীবনে। পড়ালেখার প্রতি মেয়ের আগ্রহ দেখে আমি কোলে করে ক্লাসে নিয়ে যাই। এবার শিক্ষায় আমার মেয়ে সেরা জয়িতা নির্বাচিত হওয়ায় মনে হচ্ছে, আমার পরিশ্রম বৃথা যায়নি। সবাই আমার মেয়ের জন্য দোয়া করেবেন। এই কথাগুলো বলতে বলতেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন সনিয়ার মা।’

গত ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের আয়োজনে সনিয়ার হাতে শিক্ষা ও চাকুরী ক্যাটাগরিতে সেরা জয়িতার সম্মাননা পুরস্কার ও সনদ তোলে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সারমিনা সাত্তার ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ্জহুরা। এসময় বিভিন্ন রাজনৈতিকদল, ছাত্র-সুশীল সমাজসহ সকল শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।

সনিয়ার বাড়ি উপজেলার রাজিবপুর ইউনিয়নের উজান-চরনওপাড়া গ্রামে। কৃষক বাবা রইছ উদ্দিনের অভাব-অনটনের ঘরে জন্ম তার। দুই ভাই আর চার বোনের মধ্যে সনিয়া তৃতীয়।
অভাব, প্রতিকূলতা আর শত বঞ্চনার মাঝেই তার বেড়ে ওঠা। তবুও হাল ছাড়েননি সনিয়া।

হামাগুড়ি ও মায়ের কোলে চড়েই এগিয়ে চলেছে তার শিক্ষা জীবন। কৈশোরে মাইলের পর মাইল হেঁটে দূরের গ্রাম থেকে নিয়মিত স্কুলে আসতেন তিনি। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে এখন তিনি ঈশ্বরগঞ্জ সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। এর আগে উপজেলার উচাখিলা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও আলীনগর কারিগরি বাণিজ্যিক কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সনিয়া।

 

সনিয়া বলেন, ‘ছোট বেলা থেকেই আমার মা-বাবা কষ্ট করে আমাকে বড় করেছেন। আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন পায়ের রক্তনালীতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে ইনফেকশন হয়। আমার দুটি পা কেটে ফেলা হয়। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি, পড়াশোনা শেষ করে একটি চাকরি নিয়ে বাবা-মায়ের দুঃখ লাগব করে তাদের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই। শিক্ষা ক্যাটাগরিতে সেরা জয়িতা হতে পেরে খুব ভালো লাগছে। এই সম্মান আমাকে স্বপ পূরণের দিকে একধাপ এগিয়ে নিতে প্রেরণা যুগিয়েছে।

 

ঈশ্বরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. রফিকুল ইসলাম খান বলেন, সনিয়ার অদম্য আগ্রহ দেখে আমরা অভিভূত। আমাদের কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে এবার অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে মেয়েটি। রোকেয়া দিবসে সে সেরা জয়িতা নির্বাচিত হওয়ায় আমার শিক্ষক হিসেবে তাকে নিয়ে গর্ববোধ করছি। আমরা সনিয়ার উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করছি।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ্জহুরা বলেন, ‘শিক্ষার প্রতি অদম্য চেষ্টা ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে লেখাপড়া চালিয়ে নিতে জীবনে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে সনিয়াকে। তাই তাকে উৎসাহ দিতে শিক্ষা ও চাকুরী ক্যাটাগরিতে সেরা জয়িতা মনোনীত করে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।’

 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) সারমিনা সাত্তার বলেন, ‘প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল থেকে ওঠে আসা সনিয়া এখন অন্য শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা। মেয়েটার কতো আগ্রহ, দুটি পা না থাকা সত্ত্বেও স্নাতক পর্যন্ত লেখাপড়া করা সত্যিই অনেক কঠিন। কিন্তু সনিয়া তা পেরেছে, সে হতে পারে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের পরবর্তী দৃষ্টান্ত। তাকে সেরা জয়িতা নির্বাচিত করতে পেরে উপজেলা প্রশাসন এবং আমি নিজেও গর্ববোধ করছি।’