০৯:৪৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মোগল স্থাপত্যের কালের সাক্ষী ঘাগড়া লস্কর খান মসজিদ

শেরপুরে ঘাগড়া লস্কর খান জামে মসজিদ। ছবি- ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস।

 

কালের কপোল তলে কাল হারায়। সময় হারিয়ে যায়। থেকে যায় সময়ের কর্ম। তেমনই আজো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় চারশ’ বছর আগের মোগল আমলের ‘ঘাগড়া লস্কর খান বাড়ি জামে মসজিদ’। মসজিদটির সঠিক পরিচর্যার অভাবে এখন ভঙ্গুর অবস্থার দিকেই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এমন অভিযোগ করেছেন ওই এলাকার সচেতন মহল ও প্রবীণ লোকজন।

প্রাচীনতম এই মসজিদের বাইরে থেকে বিশাল আকৃতির মণে হলেও তার ভেতরে খুব একটা বেশী বড় নয়। এক গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদের উত্তর এবং দক্ষিণে রয়েছে দু’টি জানালা। মসজিদের ভেতর ইমাম ছাড়া তিন কাতারে দশ জন করে মোট ত্রিশ জন মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে মসজিদের বাইরে বারান্দায় আরো কম পক্ষে পঞ্চাশ জন মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে মসজিদটির আকার বা পরিধি যাই হোক না কেন মসজিদে নামাজ আদায়ের সময় সবারই মনে হবে যে, চারশ’ বছর পেছনে চলে এসেছি। এ যেন কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি যা কিনা নিজে উপস্থিত হয়ে নামাজ আদায় না করলে বিশ্বাস বা বোঝানো সম্ভব নয়।

স্থাপত্যকলার অনুপম নিদর্শন ঐতিহাসিক ‘খানবাড়ি মসজিদটি শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার ঘাগড়া লস্কর গ্রামে অবস্থিত। আর তাই হয়তোবা এই প্রাচীনতম মসজিদের নাম ও কালক্রমে ‘ঘাগড়া লস্কর খানবাড়ি মসজিদ’ হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে।

মোগল শাসন আমলের ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে শেরপুর জেলা সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে ঝিনাইগাতী উপজেলার হাতীবান্ধা ইউনিয়নের ঘাগড়া লস্কর গ্রামে মোগল স্থাপত্যকলার অনুপম নিদর্শন ঐতিহাসিক ‘খান বাড়ী’ মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মসজিদের গায়ে বর্তমানে যেসব নির্দশন পাওয়া গেছে সে অনুসারে ধারণা করা হয়, বক্সার বিদ্রোহীদের নেতা হিরোঙ্গি খাঁর বিদ্রোহের সময় মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। আজিমোল্লাহ খান ৫৮ শতক জায়গার উপর মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করে ওয়াকফ করে দেন।

মসজিদের দরজার ওপর অত্যন্ত মূল্যবান কষ্টিপাথরের ওপর খোদাই করে আরবিতে প্রতিষ্ঠাকাল হিজরি ১২২৮ এবং ইংরেজী ১৮০৮ সাল লিখা রয়েছে। যদিও ওই খোদাই করা কষ্টিপাথরের ফলকটি ২০২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর চুরি হয়ে যায়।

মসজিদটির গঠন পদ্ধতি এবং স্থাপত্য কৌশল শিল্পসমৃদ্ধ ও সুদৃশ্য। এর ভেতরে রয়েছে দু’টি সুদৃঢ় খিলান। এক গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদটির দৈর্ঘ-প্রস্থ উভয় দিকেই সমান। ভেতরের ভাগ ৩০ ফুট দৈর্ঘ এবং ৩০ ফুট প্রস্থ। মসজিদটির মধ্যস্থলে বড় গম্বুজের চারপাশ ঘিরে ছোট-বড় দশটি মিনার রয়েছে। তার মধ্যে আবার চার কোনায় রয়েছে চারটি। মসজিদটিতে রয়েছে মাত্র একটি দরজা। ভেতরে মেহরাব এবং দেয়াল অঙ্কিত বিভিন্ন কারুকাজের ফুলদানি এবং ফুল।
ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন খান বাড়ীর লোকজনসহ গ্রামের লোকজন ৫৮ শতক জমি মসজিদের জন্য ওয়াকফ করে দেন। তার মধ্যে মসজিদটির মূল ভবন এবং বারান্দা রয়েছে ১৭ শতকের ওপর। ৪১ শতকের ওপর রয়েছে কবরস্থান। মসজিদের বর্তমান ইমাম হাফেজ মোঃ রহুল আমীন জুম্মাসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ান।
জানা যায়, প্রায় দুই যুগ আগে মসজিদের ২১ সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা কমিটি গঠন করা হলেও ওই কমিটির সভাপতি গোলাম মোস্তফা খান মৃত্যুবরণ করার পর থেকে আর কোন কমিটি গঠন করা হয়নি। কামরুজ্জামান খান দেখভাল করে আসলেও বর্তমানে তিনি এবং ক্যাশিয়ার মামুন খান পেশাগতকারণে দীর্ঘদিন থেকে ঢাকায় অবস্থান করছেন। তার পরও মসজিদের গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় কাজ তারাই করে থাকেন।

সূত্র মতে, মাঝেমধ্যে ঢাকা জাতীয় জাদুঘর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লোকজন এসে মসজিদটি ধোয়া-মোছা এবং কিছু কিছু সংস্কার কাজ দায়সারা ভাবে করেগেলেও গত ১৫ বছরে একজন কেয়ারটেকার, একটি সতর্কবাণী লাগানো এবং বছরে হয়তো বা বড়জোর একবার রং করা ছাড়া আর কোন ভূমিকাই পালন করছেন না। বর্তমানে মসজিদটির মেঝে দেবে যাচ্ছে এবং দেয়ালেও ফাটল ধরেছে। এছাড়া ইতিমধ্যে মসজিদের মূল্যবান কষ্টি পাথরের নাম ফলকটি চুরি হয়ে গেছে। অভিজ্ঞমহলের মতে দ্রত সংস্কারের ব্যবস্থা না নিলে কালের এই নীরব সাক্ষী খানবাড়ি মসজিদটি অত্যন্ত নীরবেই হারিয়ে যাবে।

ট্যাগ :
অধিক পঠিত

ময়মনসিংহ বেতারে সঙ্গীত বিভাগ শুরু যেন এক নবদিগন্তের যাত্রা

মোগল স্থাপত্যের কালের সাক্ষী ঘাগড়া লস্কর খান মসজিদ

পোষ্টের সময় : ০৪:৩৩:৫৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫

 

কালের কপোল তলে কাল হারায়। সময় হারিয়ে যায়। থেকে যায় সময়ের কর্ম। তেমনই আজো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় চারশ’ বছর আগের মোগল আমলের ‘ঘাগড়া লস্কর খান বাড়ি জামে মসজিদ’। মসজিদটির সঠিক পরিচর্যার অভাবে এখন ভঙ্গুর অবস্থার দিকেই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এমন অভিযোগ করেছেন ওই এলাকার সচেতন মহল ও প্রবীণ লোকজন।

প্রাচীনতম এই মসজিদের বাইরে থেকে বিশাল আকৃতির মণে হলেও তার ভেতরে খুব একটা বেশী বড় নয়। এক গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদের উত্তর এবং দক্ষিণে রয়েছে দু’টি জানালা। মসজিদের ভেতর ইমাম ছাড়া তিন কাতারে দশ জন করে মোট ত্রিশ জন মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে মসজিদের বাইরে বারান্দায় আরো কম পক্ষে পঞ্চাশ জন মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে মসজিদটির আকার বা পরিধি যাই হোক না কেন মসজিদে নামাজ আদায়ের সময় সবারই মনে হবে যে, চারশ’ বছর পেছনে চলে এসেছি। এ যেন কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি যা কিনা নিজে উপস্থিত হয়ে নামাজ আদায় না করলে বিশ্বাস বা বোঝানো সম্ভব নয়।

স্থাপত্যকলার অনুপম নিদর্শন ঐতিহাসিক ‘খানবাড়ি মসজিদটি শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার ঘাগড়া লস্কর গ্রামে অবস্থিত। আর তাই হয়তোবা এই প্রাচীনতম মসজিদের নাম ও কালক্রমে ‘ঘাগড়া লস্কর খানবাড়ি মসজিদ’ হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে।

মোগল শাসন আমলের ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে শেরপুর জেলা সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে ঝিনাইগাতী উপজেলার হাতীবান্ধা ইউনিয়নের ঘাগড়া লস্কর গ্রামে মোগল স্থাপত্যকলার অনুপম নিদর্শন ঐতিহাসিক ‘খান বাড়ী’ মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মসজিদের গায়ে বর্তমানে যেসব নির্দশন পাওয়া গেছে সে অনুসারে ধারণা করা হয়, বক্সার বিদ্রোহীদের নেতা হিরোঙ্গি খাঁর বিদ্রোহের সময় মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। আজিমোল্লাহ খান ৫৮ শতক জায়গার উপর মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করে ওয়াকফ করে দেন।

মসজিদের দরজার ওপর অত্যন্ত মূল্যবান কষ্টিপাথরের ওপর খোদাই করে আরবিতে প্রতিষ্ঠাকাল হিজরি ১২২৮ এবং ইংরেজী ১৮০৮ সাল লিখা রয়েছে। যদিও ওই খোদাই করা কষ্টিপাথরের ফলকটি ২০২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর চুরি হয়ে যায়।

মসজিদটির গঠন পদ্ধতি এবং স্থাপত্য কৌশল শিল্পসমৃদ্ধ ও সুদৃশ্য। এর ভেতরে রয়েছে দু’টি সুদৃঢ় খিলান। এক গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদটির দৈর্ঘ-প্রস্থ উভয় দিকেই সমান। ভেতরের ভাগ ৩০ ফুট দৈর্ঘ এবং ৩০ ফুট প্রস্থ। মসজিদটির মধ্যস্থলে বড় গম্বুজের চারপাশ ঘিরে ছোট-বড় দশটি মিনার রয়েছে। তার মধ্যে আবার চার কোনায় রয়েছে চারটি। মসজিদটিতে রয়েছে মাত্র একটি দরজা। ভেতরে মেহরাব এবং দেয়াল অঙ্কিত বিভিন্ন কারুকাজের ফুলদানি এবং ফুল।
ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন খান বাড়ীর লোকজনসহ গ্রামের লোকজন ৫৮ শতক জমি মসজিদের জন্য ওয়াকফ করে দেন। তার মধ্যে মসজিদটির মূল ভবন এবং বারান্দা রয়েছে ১৭ শতকের ওপর। ৪১ শতকের ওপর রয়েছে কবরস্থান। মসজিদের বর্তমান ইমাম হাফেজ মোঃ রহুল আমীন জুম্মাসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ান।
জানা যায়, প্রায় দুই যুগ আগে মসজিদের ২১ সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা কমিটি গঠন করা হলেও ওই কমিটির সভাপতি গোলাম মোস্তফা খান মৃত্যুবরণ করার পর থেকে আর কোন কমিটি গঠন করা হয়নি। কামরুজ্জামান খান দেখভাল করে আসলেও বর্তমানে তিনি এবং ক্যাশিয়ার মামুন খান পেশাগতকারণে দীর্ঘদিন থেকে ঢাকায় অবস্থান করছেন। তার পরও মসজিদের গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় কাজ তারাই করে থাকেন।

সূত্র মতে, মাঝেমধ্যে ঢাকা জাতীয় জাদুঘর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লোকজন এসে মসজিদটি ধোয়া-মোছা এবং কিছু কিছু সংস্কার কাজ দায়সারা ভাবে করেগেলেও গত ১৫ বছরে একজন কেয়ারটেকার, একটি সতর্কবাণী লাগানো এবং বছরে হয়তো বা বড়জোর একবার রং করা ছাড়া আর কোন ভূমিকাই পালন করছেন না। বর্তমানে মসজিদটির মেঝে দেবে যাচ্ছে এবং দেয়ালেও ফাটল ধরেছে। এছাড়া ইতিমধ্যে মসজিদের মূল্যবান কষ্টি পাথরের নাম ফলকটি চুরি হয়ে গেছে। অভিজ্ঞমহলের মতে দ্রত সংস্কারের ব্যবস্থা না নিলে কালের এই নীরব সাক্ষী খানবাড়ি মসজিদটি অত্যন্ত নীরবেই হারিয়ে যাবে।