খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সামান্য ঘটনায় যেইভাবে সমগ্র পার্বত্যাঞ্চল অশান্ত হইয়া উঠিয়াছে উহা উদ্বেগজনক। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে বাঙালি-পাহাড়ি মুখোমুখি সংঘর্ষে কেবল বাড়িঘর-দোকানপাটই ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই, ইহার সহিত চারটি মূল্যবান প্রাণও ঝরিয়াছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি করিতে হইয়াছে। সেনাবাহিনী তথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনিবার চেষ্টা করিতেছে বটে, কিন্তু বাঙালি-পাহাড়িদের মধ্যে সদ্ভাব না থাকিলে সমস্যার সমাধান হইবে না এবং পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা স্বপ্নই থাকিয়া যাইবে।
আমরা জানি, আড়াই যুগের বেশি সময় অতিক্রান্ত হইলেও পার্বত্য শান্তিচুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় নাই। তথায় ভূমি সমস্যার সমাধান না হওয়াসহ নানা সংকট এখনও জিয়াইয়া রাখিবার কারণে ছোটখাটো বিরোধও বৃহৎ হাঙ্গামার রূপ পরিগ্রহ করিতেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ও কমিশন গঠন করা হইয়াছে বটে, কিন্তু ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আইনের বিধিমালা এখনও চূড়ান্ত করা হয় নাই বলিয়াই এতদিনেও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সফলতা দেখা যায় নাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য রক্ষার বিষয়টিও অনিষ্পন্ন রহিয়া গিয়াছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসংবলিত বিশেষ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিও পাহাড়িদের তরফ হইতে রহিয়াছে।
অস্বীকার করা যাইবে না, পাহাড়িদের মধ্যকার বিরোধও সংকট আরও গভীর করিয়াছে। শান্তিচুক্তি হইবার পর পাহাড়ি সংগঠনগুলো নানা ভাগে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছে। তাহাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিয়া থাকে এবং উহা খুনোখুনি পর্যন্ত গড়ায়। ইহাও সত্য, সমতলে যেইরূপ উন্নয়ন হইয়াছে সেই তুলনায় পার্বত্যাঞ্চল বৈষম্যের শিকার। দুর্গম হইবার কারণে পাহাড়ের অনেক এলাকায়ই উন্নয়নের ছোঁয়া পড়ে নাই।
তবে পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালিদের প্রতি যেই অবিশ্বাস রহিয়াছে, উহাই চলমান সংকটের মূল কারণ। আমরা মনে করি, যেই কোনো প্রকারেই হউক উহাদের মধ্যকার বিরোধ মিটাইয়া পাহাড়ে শান্তি ফিরাইতে হইবে। এই ক্ষেত্রে সরকারকে উক্ত জনগোষ্ঠীকে আস্থায় আনিতে হইবে। আমরা দেখিয়াছি, সৃষ্ট সংকটে শনিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি দল রাঙামাটি পরিদর্শন করিয়াছে। তিনি পাহাড়ে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তদন্ত দল গঠন করাসহ এই ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করিবার কথা বলিয়াছেন। আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার পাহাড়ে শান্তির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করিবে এবং উহা কেবল অঙ্গীকারে সীমাবদ্ধ থাকিবে না।
আমরা প্রধান উপদেষ্টার আশ্বাসে আশ্বস্ত হইতে চাই। তিনি ইতোমধ্যে পার্বত্য তিন জেলার বাসিন্দাদের শান্ত থাকিবার আহ্বান জানাইয়াছেন এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সংযমেরও তাগিদ দিয়াছেন। দীঘিনালার সাধারণ ঘটনা কীভাবে এতটা প্রাণঘাতী হইল? তথায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবহেলা রহিয়াছে কিনা, খতাইয়া দেখিতে হইবে। ইতোমধ্যে পাহাড় লইয়া নানামুখী গুজব শাখাপ্রশাখা মেলিয়াছে। সামান্য ঘটনা এত বৃহৎ সংঘাতে রূপ লইবার ক্ষেত্রেও উহার ভূমিকা অস্বীকার করা যাইবে না। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআরের আশঙ্কা, চলমান উত্তেজনার জেরে তিন পার্বত্য জেলা ভয়াবহ দাঙ্গাকবলিত হইতে পারে। এই পরিস্থিতিতে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের চলমান উত্তেজনা প্রশমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করিবার যেই অনুরোধ সংস্থাটি করিয়াছে, উহা আমলযোগ্য। আমরা বিশ্বাস করি, তিন পার্বত্য জেলায় শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখিতে স্থানীয়দের ভূমিকাই প্রধান। তবে চলমান সংঘাতে যাহারা ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে তাহাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দীর্ঘ মেয়াদে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরাইতে যথাযথ ব্যবস্থা লওয়া জরুরি। পার্বত্যাঞ্চল অশান্ত হইলে সমতলের শান্তিও ঝুঁকিতে পড়ে বৈকি!