ঈদুল ফিতর বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসব পারস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে ভ্রাতৃত্ব ও আনন্দের বার্তা ছড়িয়ে দেয়। ‘ঈদ’ শব্দের অর্থ আনন্দ বা উৎসব।
এই ঈদের অন্যতম আকর্ষণ হলো ‘ঈদ সালামি’, যা বড়দের সালাম করে উপহার বা অর্থ পাওয়ার প্রথা। এটি ‘ঈদি’ বা ‘ঈদিয়া’ নামেও পরিচিত। ‘ঈদিয়া’ শব্দটি ‘ঈদ’ ও আরবি ‘হাদিয়া’ থেকে এসেছে, যা মূলত উপহার হিসেবে দেওয়া হয়।
ঈদ সালামির ইতিহাস:
ঈদ সালামির সূচনাকাল সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য নেই, তবে এটি ব্রিটিশ আমলের বাংলায় প্রচলিত ছিল। অনেকে এর শুরু ফাতিমীয় খিলাফতের (১০ম শতাব্দী) সময় মিসরে হয়েছে বলে মনে করেন, যেখানে বড়রা ছোটদের অর্থ বা উপহার দিতেন। পরে এটি অটোমান সাম্রাজ্য ও আরবে ছড়িয়ে পড়ে, এবং নগদ অর্থের পাশাপাশি নতুন কাপড় ও মিষ্টিও ঈদের উপহার হিসেবে যুক্ত হয়।
বাংলায় ঈদ উৎসব একসময় ছিল সীমিত পরিসরের। এর দুটি মূল কারণ ছিল—প্রথমত, গ্রামবাংলার মুসলমানরা ছিলেন দরিদ্র, এবং দ্বিতীয়ত, তখনো মুসলমানদের মধ্যে স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ের অনুভূতি ততটা প্রবল হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে সামাজিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা কঠিন ছিল। নবাব-বাদশাহরা ঈদ পালন করলেও তা মূলত অভিজাতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, সাধারণ মানুষের কাছে ঈদের গুরুত্ব ততটা প্রবেশ করতে পারেনি। তবে উনিশ শতকের ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফলে গ্রাম ও শহরের উৎসবে নতুনত্ব আসে। এরপর বিশ শতকের চতুর্থ দশক থেকে ঈদ উৎসব ধীরে ধীরে সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়, ইসলামে উপহার আদান-প্রদানের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে; তবে সেটি কোনো শর্তযুক্ত হতে পারবে না। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা একে অন্যকে উপহার দাও, এতে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। (সূত্র: আল-আদাবুল মুফরাদ; হাদিস নং: ৫৯৪)
ঈদ সালামির একটি বিশেষ দিক হলো নতুন ও চকচকে নোট দেওয়া, যা মানুষের চাহিদার কথা মাথায় রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরবরাহ করে। পাশাপাশি উপহার ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্থনীতিও সক্রিয় থাকে। সময়ের সঙ্গে সালামির রীতিতে পরিবর্তন এসেছে, প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দূরবর্তী প্রিয়জনের কাছেও সহজে পাঠানো যাচ্ছে।
সালামির মূল উদ্দেশ্য অর্থের পরিমাণ নয়, বরং সবাই মিলে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করা। এটি এখন শুধু শিশুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অফিসসহ নানা সামাজিক পরিসরে আনুষ্ঠানিকতার অংশ হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসারে ঈদ সালামির প্রচলন আরও ব্যাপকতা পেয়েছে, যা পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জোরদার করার পাশাপাশি শিশুদের মাঝে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে দেয়।