০১:৩৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সামনেই নির্বাচন: ঈদ ঘিরে ময়মনসিংহে সরব বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা

 

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পবিত্র ঈদুল আজহাকে ঘিরে নির্বাচনী মাঠে সরব হয়ে উঠেছেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। ময়মনসিংহ জেলার ১১টি সংসদীয় আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ময়মনসিংহ জেলা অতিগুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহৎ জেলা। আন্দোলন-সংগ্রামেও এই জেলার ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। ফলে সাম্প্রতিক নির্বাচনী ডামাডোলে নিজ নিজ এলাকামুখী হয়ে উঠেছেন বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।

রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই জেলায় প্রায় অর্ধশতাধিক নেতা বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে সক্রিয়। হেভিওয়েট ও নবীন প্রার্থীদের পাশাপাশি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় এবং দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় নেতারাও এবার মনোনয়ন দৌড়ে শামিল হয়েছেন। ঈদ উপলক্ষে অনেকে স্থানীয় নেতাকর্মীদের জন্য ঈদ উপহার ও আর্থিক অনুদান পাঠিয়েছেন, যার মধ্যে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে ‘ঈদ সেলামি’ দেওয়ার ঘটনাও আছে।

 

দলীয় সূত্র জানায়, বিগত ১৫ বছরের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন, সংগ্রামে হামলা-মামলা ও গুম-খুনে বিপর্যস্ত বিএনপির নেতাকর্মীরা। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দলটির মন্ত্রী-এমপি ও এলাকার বেশিরভাগ দাপুটে নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দল গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বিএনপি ও দলটির অঙ্গ সহযোগী সংগঠন। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক জেলা, মহানগর ও উপজেলা কমিটি গঠন হওয়ায় ওয়ার্ড এবং ইউনিয়ন পর্যায়েও চলছে বিএনপির কমিটি গঠনের তোড়জোড়। এতে তৃণমূল পর্যায়ে দলটির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নেতাকর্মীদের সক্রিয় সম্পৃক্ততা বেড়েছে বহুগুণ। এক্ষেত্রে সুযোগ বুঝে ভোল পাল্টিয়ে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী নেতাকর্মীরাও বিএনপিতে ভিড়ছে বলে অভিযোগ দলটির নেতাকর্মীদের। তবে এ নিয়েও দলের উচ্চ পর্যায় থেকে রয়েছে বেশ সতর্ক বার্তা।

নেতাকর্মীরা জানান, সংগঠন গোছানোর পাশাপাশি বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এখন নির্বাচনমুখী। এরমধ্যে বিগত ১৫ বছর আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে থাকা নেতাদের পাশাপাশি নির্বাচনী মাঠে জায়গা করতে উঠেপড়ে লেগেছে নিষ্ক্রিয়রাও। তারাও এখন নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে টানতে টাকা খরচ করে পাঠাচ্ছেন ঈদ উপহার। সেইসঙ্গে বিকাশ-নগদেও দিচ্ছেন ঈদ সেলামি। তবে এবারের দলীয় মনোনয়নে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ত্যাগী ও নির্যাতিতদের ধানের শীষ প্রতীকে মূল্যায়ন করবেন বলে আশাবাদী গৌরীপুর উপজেলা বিএনপির সদস্য মো. হারুন অর রশিদ মণ্ডলসহ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

সূত্র মতে, ময়মনসিংহ তথা দেশের সীমান্তবর্তী উপজেলা হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া আসন নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন ময়মনসিংহ-১। এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে মাঠে রয়েছেন হেভিওয়েট প্রার্থী বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও দলের দুঃসময়ের পরীক্ষিত নেতা সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে হামলা-মামলায় গ্রেপ্তার হয়েও দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে তিনি ছুটেছেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। সেইসঙ্গে টানা ১০ বছর ধরে এই আসনের প্রতিটি গ্রামে, পাড়া-মহল্লায় সরব ছিলেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা মানুষের সুখে-দুঃখে। তার সঙ্গে প্রার্থিতায় লড়বেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা প্রবীণ সাংবাদিক ও আইনজীবী আফজাল এইচ খান ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তরুণ রাজনীতিক সালমান ওমর রুবেল।

ফুলপুর-তারাকান্দা উপজেলার নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন ময়মনসিংহ-২। এই আসনে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য শাহ শহীদ সারোয়ার বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের সঙ্গে বেইমানি করে আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী হয়ে বহিষ্কার হন বিএনপি থেকে। ফলে আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে এই আসনে বিএনপির মনোনয়নের মূল আলোচনায় রয়েছেন দলের দুঃসময়ের পরীক্ষিত জেলা উত্তর বিএনপির একমাত্র সদস্য সচিব মোতাহার হোসেন তালুকদার। তার সঙ্গে প্রার্থীতায় আছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও উত্তর জেলা কৃষকদলের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল বাসার আকন্দ ও ময়মনসিংহ মহানগর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক জোবায়েদ হোসেন শাকিল।

ব্রিটিশ শাসনে রাজা-জমিদারের তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিত জেলার গৌরীপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-৩ আসন। এই আসনে তৃণমূলের জনপ্রিয়তার আলোচনায় বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও নবগঠিত উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আহম্মেদ তায়েবুর রহমান হিরন। তার সঙ্গে মনোনয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মো. ইকবাল হোসাইন, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মো. নূরুল হক, উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব হাফেজ আজিজুল হক ও ড্যাব নেতা ডা. আব্দুস সেলিম।

দেশের অষ্টম বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহ সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-৪ আসন। এই আসনে ২০১৮ সালের নির্বাচনে লক্ষাধিক ভোট পেয়ে দেশজুড়ে নজির সৃষ্টি করেছিলেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ ওয়াহিদ। এবারও তিনি এই আসনে বিএনপির আলোচিত মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে ২০১৮ সালে আসনটিতে মামলা জটিলতায় প্রার্থী হতে পারেননি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। এ ছাড়া এই আসনে এবার মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়েছেন মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক শেখ আমজাদ আলী, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রোকনুজ্জামান সরকার রোকন।

জেলার উত্তর-পশ্চিমের জনপদ জমিদারি স্থাপত্যের ঐতিহ্য সম্বলিত মুক্তাগাছা উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-৫ আসন। এতে বিএনপির একমাত্র আলোচিত মনোনয়ন প্রত্যাশী দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক জাকির হোসেন বাবলু। তার সঙ্গে মনোনয়ন চাইতে পারেন সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া হারুন।

লাল চিনি ও কাঁচা হলুদের জন্য বিখ্যাত পাহাড়ি জনপদ ঘেঁষা ফুলবাড়ীয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-৬ আসন। এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন চাইবেন নবগঠিত দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আকতারুল আলম ফারুক, কেন্দ্রীয় যুবদল নেতা আব্দুল করিম সরকারসহ আরও কয়েক জন।

 

ময়মনসিংহ-৭ আসনটি ত্রিশাল উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই আসনে বিএনপির হেভিওয়েট মনোনয়ন প্রত্যাশী দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. মাহাবুবুর রহমান লিটন। তার সঙ্গে মনোনয়ন চাইবেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন ও নবগঠিত দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. শহীদুল আমিন খসরু।

 

ময়মনসিংহ-৮ ঈশ্বরগঞ্জ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে বিগত আন্দোলনে অর্থ যোগানদাতা হিসেবে গ্রেপ্তার হয়ে নির্যাতন ও কারাবন্দি হওয়ায় দলটির তৃণমূলে আলোচনায় চমক সৃষ্টি করেছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক প্রকৌশলী লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবু। ফলে দলটির তৃণমূল পর্যায়ে তাকে ঘিরে চলছে মনোনয়ন গুঞ্জন। তবে তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন সাবেক এমপি শাহ নূরুল কবীর শাহীন।

 

নান্দাইল উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-৯ আসন। এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে তৃণমূলে দল গোছাতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক প্রয়াত সংসদ সদস্যের ছেলে ইয়াসের খান চৌধুরী। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন আরেক সাবেক সংসদ সদস্যের ছেলে নাসের খান চৌধুরী। তারা পারিবারিকভাবে সম্পর্কে চাচাতো ভাই। এ ছাড়া আসনটিতে বিএনপির মনোনয়ন চাইবেন অবসরপ্রাপ্ত ও আলোচিত সেনা কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামসুল ইসলাম শামছ।

 

রাজনীতির রক্তাক্ত জনপদ হিসেবে পরিচিত জেলার গফরগাঁও উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-১০ আসন। এই আসনে ধানের শীষের মনোনয়ন চাইছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সাবেক ছাত্রনেতা আলমগীর মাহমুদ আলম। এ ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন প্রবীণ বিএনপি নেতা এবি সিদ্দিক, তার ভাতিজা প্রয়াত সংসদ সদস্যের ছেলে তরুণ বিএনপি নেতা মুশফিকুর রহমান।

 

দেশের শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত ভালুকা উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-১১ আসন। এই আসনে একাধিক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী রয়েছেন বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায়। তারা হলেন- বিএনপি নেতা ফকরুদ্দিন আহম্মেদ বাচ্চু, নবগঠিত দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মুহাম্মদ মুর্শেদ আলমসহ আরও কয়েক জন।

নির্বাচনী তোড়জোড় বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ ওয়াহিদ বলেন, আমাদের নেতা তারেক রহমান বলেছেন জনগণের পাশে থাকুন, জনগণের সঙ্গে থাকুন। আমরা এই নির্দেশনা মেনেই এলাকায় কাজ করছি। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে খুব দ্রুত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আগামীর বাংলাদেশ গঠনে আমরা বদ্ধপরিকর।

 

এ বিষয়ে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, শুধু ঈদ নয়। বিএনপি সবসময়ই গণমুখী দল। নির্বাচন ও আন্দোলন সবক্ষেত্রেই দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে সরব রয়েছে বিএনপি।

 

উল্লেখ্য, শুক্রবার (৬ জুন) সন্ধ্যায় পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

 

ট্যাগ :

সামনেই নির্বাচন: ঈদ ঘিরে ময়মনসিংহে সরব বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা

পোষ্টের সময় : ০৩:২৮:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫

 

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পবিত্র ঈদুল আজহাকে ঘিরে নির্বাচনী মাঠে সরব হয়ে উঠেছেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। ময়মনসিংহ জেলার ১১টি সংসদীয় আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ময়মনসিংহ জেলা অতিগুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহৎ জেলা। আন্দোলন-সংগ্রামেও এই জেলার ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। ফলে সাম্প্রতিক নির্বাচনী ডামাডোলে নিজ নিজ এলাকামুখী হয়ে উঠেছেন বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।

রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই জেলায় প্রায় অর্ধশতাধিক নেতা বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে সক্রিয়। হেভিওয়েট ও নবীন প্রার্থীদের পাশাপাশি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় এবং দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় নেতারাও এবার মনোনয়ন দৌড়ে শামিল হয়েছেন। ঈদ উপলক্ষে অনেকে স্থানীয় নেতাকর্মীদের জন্য ঈদ উপহার ও আর্থিক অনুদান পাঠিয়েছেন, যার মধ্যে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে ‘ঈদ সেলামি’ দেওয়ার ঘটনাও আছে।

 

দলীয় সূত্র জানায়, বিগত ১৫ বছরের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন, সংগ্রামে হামলা-মামলা ও গুম-খুনে বিপর্যস্ত বিএনপির নেতাকর্মীরা। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দলটির মন্ত্রী-এমপি ও এলাকার বেশিরভাগ দাপুটে নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দল গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বিএনপি ও দলটির অঙ্গ সহযোগী সংগঠন। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক জেলা, মহানগর ও উপজেলা কমিটি গঠন হওয়ায় ওয়ার্ড এবং ইউনিয়ন পর্যায়েও চলছে বিএনপির কমিটি গঠনের তোড়জোড়। এতে তৃণমূল পর্যায়ে দলটির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নেতাকর্মীদের সক্রিয় সম্পৃক্ততা বেড়েছে বহুগুণ। এক্ষেত্রে সুযোগ বুঝে ভোল পাল্টিয়ে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী নেতাকর্মীরাও বিএনপিতে ভিড়ছে বলে অভিযোগ দলটির নেতাকর্মীদের। তবে এ নিয়েও দলের উচ্চ পর্যায় থেকে রয়েছে বেশ সতর্ক বার্তা।

নেতাকর্মীরা জানান, সংগঠন গোছানোর পাশাপাশি বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এখন নির্বাচনমুখী। এরমধ্যে বিগত ১৫ বছর আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে থাকা নেতাদের পাশাপাশি নির্বাচনী মাঠে জায়গা করতে উঠেপড়ে লেগেছে নিষ্ক্রিয়রাও। তারাও এখন নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে টানতে টাকা খরচ করে পাঠাচ্ছেন ঈদ উপহার। সেইসঙ্গে বিকাশ-নগদেও দিচ্ছেন ঈদ সেলামি। তবে এবারের দলীয় মনোনয়নে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ত্যাগী ও নির্যাতিতদের ধানের শীষ প্রতীকে মূল্যায়ন করবেন বলে আশাবাদী গৌরীপুর উপজেলা বিএনপির সদস্য মো. হারুন অর রশিদ মণ্ডলসহ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

সূত্র মতে, ময়মনসিংহ তথা দেশের সীমান্তবর্তী উপজেলা হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া আসন নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন ময়মনসিংহ-১। এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে মাঠে রয়েছেন হেভিওয়েট প্রার্থী বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও দলের দুঃসময়ের পরীক্ষিত নেতা সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে হামলা-মামলায় গ্রেপ্তার হয়েও দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে তিনি ছুটেছেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। সেইসঙ্গে টানা ১০ বছর ধরে এই আসনের প্রতিটি গ্রামে, পাড়া-মহল্লায় সরব ছিলেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা মানুষের সুখে-দুঃখে। তার সঙ্গে প্রার্থিতায় লড়বেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা প্রবীণ সাংবাদিক ও আইনজীবী আফজাল এইচ খান ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তরুণ রাজনীতিক সালমান ওমর রুবেল।

ফুলপুর-তারাকান্দা উপজেলার নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন ময়মনসিংহ-২। এই আসনে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য শাহ শহীদ সারোয়ার বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের সঙ্গে বেইমানি করে আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী হয়ে বহিষ্কার হন বিএনপি থেকে। ফলে আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে এই আসনে বিএনপির মনোনয়নের মূল আলোচনায় রয়েছেন দলের দুঃসময়ের পরীক্ষিত জেলা উত্তর বিএনপির একমাত্র সদস্য সচিব মোতাহার হোসেন তালুকদার। তার সঙ্গে প্রার্থীতায় আছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও উত্তর জেলা কৃষকদলের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল বাসার আকন্দ ও ময়মনসিংহ মহানগর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক জোবায়েদ হোসেন শাকিল।

ব্রিটিশ শাসনে রাজা-জমিদারের তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিত জেলার গৌরীপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-৩ আসন। এই আসনে তৃণমূলের জনপ্রিয়তার আলোচনায় বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও নবগঠিত উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আহম্মেদ তায়েবুর রহমান হিরন। তার সঙ্গে মনোনয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মো. ইকবাল হোসাইন, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মো. নূরুল হক, উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব হাফেজ আজিজুল হক ও ড্যাব নেতা ডা. আব্দুস সেলিম।

দেশের অষ্টম বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহ সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-৪ আসন। এই আসনে ২০১৮ সালের নির্বাচনে লক্ষাধিক ভোট পেয়ে দেশজুড়ে নজির সৃষ্টি করেছিলেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ ওয়াহিদ। এবারও তিনি এই আসনে বিএনপির আলোচিত মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে ২০১৮ সালে আসনটিতে মামলা জটিলতায় প্রার্থী হতে পারেননি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। এ ছাড়া এই আসনে এবার মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়েছেন মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক শেখ আমজাদ আলী, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রোকনুজ্জামান সরকার রোকন।

জেলার উত্তর-পশ্চিমের জনপদ জমিদারি স্থাপত্যের ঐতিহ্য সম্বলিত মুক্তাগাছা উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-৫ আসন। এতে বিএনপির একমাত্র আলোচিত মনোনয়ন প্রত্যাশী দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক জাকির হোসেন বাবলু। তার সঙ্গে মনোনয়ন চাইতে পারেন সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া হারুন।

লাল চিনি ও কাঁচা হলুদের জন্য বিখ্যাত পাহাড়ি জনপদ ঘেঁষা ফুলবাড়ীয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-৬ আসন। এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন চাইবেন নবগঠিত দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আকতারুল আলম ফারুক, কেন্দ্রীয় যুবদল নেতা আব্দুল করিম সরকারসহ আরও কয়েক জন।

 

ময়মনসিংহ-৭ আসনটি ত্রিশাল উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই আসনে বিএনপির হেভিওয়েট মনোনয়ন প্রত্যাশী দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. মাহাবুবুর রহমান লিটন। তার সঙ্গে মনোনয়ন চাইবেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন ও নবগঠিত দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. শহীদুল আমিন খসরু।

 

ময়মনসিংহ-৮ ঈশ্বরগঞ্জ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে বিগত আন্দোলনে অর্থ যোগানদাতা হিসেবে গ্রেপ্তার হয়ে নির্যাতন ও কারাবন্দি হওয়ায় দলটির তৃণমূলে আলোচনায় চমক সৃষ্টি করেছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক প্রকৌশলী লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবু। ফলে দলটির তৃণমূল পর্যায়ে তাকে ঘিরে চলছে মনোনয়ন গুঞ্জন। তবে তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন সাবেক এমপি শাহ নূরুল কবীর শাহীন।

 

নান্দাইল উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-৯ আসন। এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে তৃণমূলে দল গোছাতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক প্রয়াত সংসদ সদস্যের ছেলে ইয়াসের খান চৌধুরী। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন আরেক সাবেক সংসদ সদস্যের ছেলে নাসের খান চৌধুরী। তারা পারিবারিকভাবে সম্পর্কে চাচাতো ভাই। এ ছাড়া আসনটিতে বিএনপির মনোনয়ন চাইবেন অবসরপ্রাপ্ত ও আলোচিত সেনা কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামসুল ইসলাম শামছ।

 

রাজনীতির রক্তাক্ত জনপদ হিসেবে পরিচিত জেলার গফরগাঁও উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-১০ আসন। এই আসনে ধানের শীষের মনোনয়ন চাইছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সাবেক ছাত্রনেতা আলমগীর মাহমুদ আলম। এ ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন প্রবীণ বিএনপি নেতা এবি সিদ্দিক, তার ভাতিজা প্রয়াত সংসদ সদস্যের ছেলে তরুণ বিএনপি নেতা মুশফিকুর রহমান।

 

দেশের শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত ভালুকা উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-১১ আসন। এই আসনে একাধিক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী রয়েছেন বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায়। তারা হলেন- বিএনপি নেতা ফকরুদ্দিন আহম্মেদ বাচ্চু, নবগঠিত দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মুহাম্মদ মুর্শেদ আলমসহ আরও কয়েক জন।

নির্বাচনী তোড়জোড় বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ ওয়াহিদ বলেন, আমাদের নেতা তারেক রহমান বলেছেন জনগণের পাশে থাকুন, জনগণের সঙ্গে থাকুন। আমরা এই নির্দেশনা মেনেই এলাকায় কাজ করছি। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে খুব দ্রুত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আগামীর বাংলাদেশ গঠনে আমরা বদ্ধপরিকর।

 

এ বিষয়ে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, শুধু ঈদ নয়। বিএনপি সবসময়ই গণমুখী দল। নির্বাচন ও আন্দোলন সবক্ষেত্রেই দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে সরব রয়েছে বিএনপি।

 

উল্লেখ্য, শুক্রবার (৬ জুন) সন্ধ্যায় পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন।