০৩:১৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চোকার্স নয়, এখন চ্যাম্পিয়ন—লর্ডসে ইতিহাস গড়ল দক্ষিণ আফ্রিকা

 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মঞ্চে বহু বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটাল দক্ষিণ আফ্রিকা। আইসিসির বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫-এর ফাইনালে ক্রিকেটের ঐতিহ্যবাহী ভেন্যু লর্ডসে তারা ৫ উইকেটের দাপুটে জয়ে পরাজিত করল শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে। এই জয়ের মাধ্যমে প্রায় তিন দশকের পুরনো ‘চোকার্স’ তকমাও ঝেড়ে ফেলল প্রোটিয়ারা।

 

দক্ষিণ আফ্রিকার এটি আইসিসির কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে প্রথম শিরোপা জয় ১৯৯৮ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পর। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে নানা ব্যর্থতা ও চাপ সামলে, অবশেষে ক্রিকেট বিশ্বকে জানান দিল—তারা আর শুধুই সম্ভাবনার দল নয়, এখন তারা চ্যাম্পিয়ন।

 

চাপের ইনিংসে ইতিহাসের নায়ক: মারক্রাম

 

অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ২৮২ রানের কঠিন লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুটা মোটেও সহজ ছিল না প্রোটিয়াদের জন্য। ইনিংসের শুরুতেই ৬ রানে উইকেট হারায় দলটি—রায়ান রিকেলটনকে ফেরান প্যাট কামিন্স। তবে এখান থেকেই শুরু হয় ম্যাচ ঘোরানোর গল্প।

 

তিন নম্বরে নামা উইয়ান মুলডার ও ওপেনার এইডেন মারক্রাম গড়েন গুরুত্বপূর্ণ জুটি, যা দলের ভিত গড়ে দেয়। মুলডার আউট হলেও (২৭ রান, স্টার্কের বলে), দৃঢ়চেতা মারক্রাম একপ্রান্তে অবিচল থাকেন।

 

অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট নিয়েও ব্যাট হাতে নামেন। দুজন মিলে গড়েন ১৫৭ রানের ঐতিহাসিক পার্টনারশিপ, যা ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেয়। মারক্রাম খেলেন এক অনবদ্য ইনিংস—১৩৬ রান, যা টেস্ট ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা। অন্যদিকে বাভুমাও খেলেন ৬৬ রানের সাহসী ইনিংস।

 

 

চতুর্থ দিনের নাটকীয়তা

 

তৃতীয় দিনের খেলা শেষ হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ২১২/২ স্কোরে—জয়ের জন্য দরকার মাত্র ৭০ রান। কিন্তু চতুর্থ দিনের শুরুতেই নাটক: কামিন্স ফিরিয়ে দেন বাভুমাকে, এরপর হ্যাজলউড ফেরান মারক্রামকে। মুহূর্তেই বদলে যেতে থাকে ম্যাচের রঙ।

 

তবে শেষ পর্যন্ত ট্রিস্টান স্টাবস ও কাইল ভেরেইনের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে জয় নিশ্চিত করে ফেলে প্রোটিয়ারা। স্টাবসের ঝুঁকিহীন ব্যাটিং ও ভেরেইনের শান্ত মেজাজ জয় এনে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে—লর্ডসে ৫ উইকেটে ঐতিহাসিক জয়।

 

রাবাদা-জাদু: প্রথম ইনিংসে ভিত্তি

 

এই জয়ের মূল ভিত গড়ে দেন পেসার কাগিসো রাবাদা। অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম ইনিংসে ২১২ রানে গুটিয়ে দিতে রাবাদা নেন ৫ উইকেট—লর্ডসে এটি তার দ্বিতীয় ফাইফার। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে কাইল জেমিসনের পর তিনিই দ্বিতীয় বোলার যিনি পাঁচ উইকেট পেয়েছেন।

 

দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বিতীয় ইনিংসে কামিন্সের বিধ্বংসী বোলিংয়ে ১৩৮ রানে অলআউট হলেও প্রথম ইনিংসে পাওয়া সেই লিডই ম্যাচে বড় ভূমিকা রাখে।

 

কামিন্সের একার লড়াই

 

অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স একাই লড়াই করেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ২৮ রান খরচায় ৬ উইকেট নিয়ে ম্যাচে ফিরে আসার পথ তৈরি করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাবাদা ও এনগিডির দারুণ বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়া তৃতীয় ইনিংসে থেমে যায় ২০৭ রানে।

 

ঐতিহাসিক লক্ষ্য, ঐতিহাসিক জয়

 

লর্ডসের ইতিহাসে ২৮২ রানের লক্ষ্য তাড়া করে জয় পাওয়ার ঘটনা খুবই বিরল—যৌথভাবে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়। সেই কঠিন লক্ষ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা যেভাবে ধৈর্য ও সাহস দেখিয়ে জিতল, তা ক্রিকেট ইতিহাসে বিশেষ জায়গা করে নেবে।

 

নতুন অধ্যায়ের সূচনা

 

চোকার্স তকমা যেটি দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাড়া করে ফিরত, আজ তা শুধুই ইতিহাস। এই জয়ে প্রমাণ হয়েছে, এই দলটি মানসিকভাবে প্রস্তুত, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং সর্বোপরি ‘চ্যাম্পিয়ন’ হবার উপযুক্ত।

 

বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫-এর শিরোপা জয়ের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকা শুধু একটি ম্যাচই জিতল না, তারা জিতল আস্থা, গর্ব আর দেশের কোটি মানুষের ভালোবাসা।

ট্যাগ :

চোকার্স নয়, এখন চ্যাম্পিয়ন—লর্ডসে ইতিহাস গড়ল দক্ষিণ আফ্রিকা

পোষ্টের সময় : ০৮:০১:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫

 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মঞ্চে বহু বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটাল দক্ষিণ আফ্রিকা। আইসিসির বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫-এর ফাইনালে ক্রিকেটের ঐতিহ্যবাহী ভেন্যু লর্ডসে তারা ৫ উইকেটের দাপুটে জয়ে পরাজিত করল শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে। এই জয়ের মাধ্যমে প্রায় তিন দশকের পুরনো ‘চোকার্স’ তকমাও ঝেড়ে ফেলল প্রোটিয়ারা।

 

দক্ষিণ আফ্রিকার এটি আইসিসির কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে প্রথম শিরোপা জয় ১৯৯৮ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পর। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে নানা ব্যর্থতা ও চাপ সামলে, অবশেষে ক্রিকেট বিশ্বকে জানান দিল—তারা আর শুধুই সম্ভাবনার দল নয়, এখন তারা চ্যাম্পিয়ন।

 

চাপের ইনিংসে ইতিহাসের নায়ক: মারক্রাম

 

অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ২৮২ রানের কঠিন লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুটা মোটেও সহজ ছিল না প্রোটিয়াদের জন্য। ইনিংসের শুরুতেই ৬ রানে উইকেট হারায় দলটি—রায়ান রিকেলটনকে ফেরান প্যাট কামিন্স। তবে এখান থেকেই শুরু হয় ম্যাচ ঘোরানোর গল্প।

 

তিন নম্বরে নামা উইয়ান মুলডার ও ওপেনার এইডেন মারক্রাম গড়েন গুরুত্বপূর্ণ জুটি, যা দলের ভিত গড়ে দেয়। মুলডার আউট হলেও (২৭ রান, স্টার্কের বলে), দৃঢ়চেতা মারক্রাম একপ্রান্তে অবিচল থাকেন।

 

অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট নিয়েও ব্যাট হাতে নামেন। দুজন মিলে গড়েন ১৫৭ রানের ঐতিহাসিক পার্টনারশিপ, যা ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেয়। মারক্রাম খেলেন এক অনবদ্য ইনিংস—১৩৬ রান, যা টেস্ট ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা। অন্যদিকে বাভুমাও খেলেন ৬৬ রানের সাহসী ইনিংস।

 

 

চতুর্থ দিনের নাটকীয়তা

 

তৃতীয় দিনের খেলা শেষ হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ২১২/২ স্কোরে—জয়ের জন্য দরকার মাত্র ৭০ রান। কিন্তু চতুর্থ দিনের শুরুতেই নাটক: কামিন্স ফিরিয়ে দেন বাভুমাকে, এরপর হ্যাজলউড ফেরান মারক্রামকে। মুহূর্তেই বদলে যেতে থাকে ম্যাচের রঙ।

 

তবে শেষ পর্যন্ত ট্রিস্টান স্টাবস ও কাইল ভেরেইনের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে জয় নিশ্চিত করে ফেলে প্রোটিয়ারা। স্টাবসের ঝুঁকিহীন ব্যাটিং ও ভেরেইনের শান্ত মেজাজ জয় এনে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে—লর্ডসে ৫ উইকেটে ঐতিহাসিক জয়।

 

রাবাদা-জাদু: প্রথম ইনিংসে ভিত্তি

 

এই জয়ের মূল ভিত গড়ে দেন পেসার কাগিসো রাবাদা। অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম ইনিংসে ২১২ রানে গুটিয়ে দিতে রাবাদা নেন ৫ উইকেট—লর্ডসে এটি তার দ্বিতীয় ফাইফার। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে কাইল জেমিসনের পর তিনিই দ্বিতীয় বোলার যিনি পাঁচ উইকেট পেয়েছেন।

 

দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বিতীয় ইনিংসে কামিন্সের বিধ্বংসী বোলিংয়ে ১৩৮ রানে অলআউট হলেও প্রথম ইনিংসে পাওয়া সেই লিডই ম্যাচে বড় ভূমিকা রাখে।

 

কামিন্সের একার লড়াই

 

অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স একাই লড়াই করেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ২৮ রান খরচায় ৬ উইকেট নিয়ে ম্যাচে ফিরে আসার পথ তৈরি করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাবাদা ও এনগিডির দারুণ বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়া তৃতীয় ইনিংসে থেমে যায় ২০৭ রানে।

 

ঐতিহাসিক লক্ষ্য, ঐতিহাসিক জয়

 

লর্ডসের ইতিহাসে ২৮২ রানের লক্ষ্য তাড়া করে জয় পাওয়ার ঘটনা খুবই বিরল—যৌথভাবে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়। সেই কঠিন লক্ষ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা যেভাবে ধৈর্য ও সাহস দেখিয়ে জিতল, তা ক্রিকেট ইতিহাসে বিশেষ জায়গা করে নেবে।

 

নতুন অধ্যায়ের সূচনা

 

চোকার্স তকমা যেটি দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাড়া করে ফিরত, আজ তা শুধুই ইতিহাস। এই জয়ে প্রমাণ হয়েছে, এই দলটি মানসিকভাবে প্রস্তুত, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং সর্বোপরি ‘চ্যাম্পিয়ন’ হবার উপযুক্ত।

 

বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫-এর শিরোপা জয়ের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকা শুধু একটি ম্যাচই জিতল না, তারা জিতল আস্থা, গর্ব আর দেশের কোটি মানুষের ভালোবাসা।