শিশু বয়সে আমরা বাবাকে শক্ত মানুষ ভেবে ভয় পেতাম, অথচ তিনিই ছিলেন সবচেয়ে নরম জায়গাটা। পরীক্ষায় ভালো ফল করলে প্রথম যার চোখ ঝিলমিল করতো, তিনি বাবা।
কোনোদিন অসুস্থ হলে, চুপিচুপি দরজার আড়াল থেকে যে চিন্তিত মুখটা উঁকি দিতো, তিনিই বাবা।
বাবা হচ্ছেন সেই মানুষ, যিনি নিজের শখ বিসর্জন দেন সন্তানের এক জোড়া জুতোর জন্য। বাজারে গেলে নিজের জন্য কিছু না কিনে সন্তানের পছন্দগুলো মনে রেখে সব নিয়ে আসেন। জিজ্ঞেস করলে বলেন, “আমার কিছু দরকার নেই।”
বাবারা কাঁদেন না, কারণ পরিবারের কেউ যেন না ভেঙে পড়ে। তাঁরা ভেঙে পড়লেও সেটা হয় আড়ালে, নিভৃতে। তাঁরা চুপ থাকেন, যাতে ঘরটা শান্ত থাকে। তাঁরা বলেন না, “ভালোবাসি,” কারণ তাঁরা সেটা হাজারটি কাজে বলে দেন।
আজ বাবা দিবস। হয়তো আমরা এখনও বাবাকে “ধন্যবাদ” বলিনি, “ভালোবাসি” বলিনি।
তবে সময় পেরিয়ে গেলে এসব শব্দ ব্যথা হয়ে ফিরে আসে মনে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী মো. মুন্তাসির মাহমুদ তার বাবাকে বলেছেন হৃদয়ের না বলা কথাগুলো।
মুন্তাসিরের সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়, ছোটবেলায় তিনি স্কুলে যেতে চাননি।
প্রথম স্কুলে যাবার দিন লুকিয়ে ছিলেন খাটের নিচে। কিন্তু তার বাবা সেদিন বকাঝকা করেননি মোটেও। ছেলের স্কুলভীতি দূর করতে নিজেই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন একটি কেজি স্কুল। আমি যেখানে পালিয়েছিলাম তিনি সেখানেই নতুন পথ গড়েছিলেন।
মুন্তাসির বলেন, “সবার মতো আমারও একটা বাবা আছে। কিন্তু অন্যদের মতো আবেগ-অনুভূতি মিশিয়ে কখনো তাকে নিয়ে কিছু লেখা হয়নি। যদিও আমার জীবনে তার অবদান লিখে শেষ করা যাবে না।
আমাদের প্রচলিত গ্রামীণ বাড়িতে ছোট থেকে ‘আব্বা’ ডাকা হতো। আব্বা আমার জীবনের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তিনি অনেক শক্ত হাতে শাসন করতেন। অনেক সময় মনে হতো, তিনি আমার শত্রু। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে আমার ধারণাগুলো ভুল প্রমাণিত হতে শুরু করল। আর সময়ের স্রোতে আব্বার সেই শাসনগুলোও হারিয়ে গেল। এখন শুধু তিনি নামাজের জন্য তাগাদা দেন, বাকি বিষয়গুলো আমার উপরই ছেড়ে দেন।”
তিনি স্মৃতিচারণায় বলেন: “আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। আমার সমবয়সী জেঠাতো ভাই ফাহিম। কদিন ধরেই শুনছিলাম আমাদের স্কুলে ভর্তি করানো হবে। স্কুলটা ছিল পাশের এলাকায়—শরিফুল স্যারের কেজি স্কুল।
সকালে মেঘলা আকাশ, পূর্ব দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া। আম্মা আমাকে গোসল করিয়ে নতুন জামা পরিয়ে দিলেন। ফাহিমও ঠিক তেমনি প্রস্তুত হচ্ছিল।
তখন আমার খুব ভয় লাগছিল। আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমারে কই নিইয়া যাইতাছেন?’ তিনি বললেন, ‘তগরে স্কুলে ভর্তি করমু তর বাহে।’
তখন আমি আর ফাহিম মিলে ঠিক করলাম—আমরা কিছুতেই স্কুলে যাব না। কোনো উপায় না পেয়ে নতুন জামাকাপড় পরেই ঘরের খাটের নিচে লুকিয়ে পড়লাম। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সবাই সারা বাড়ি তছনছ করে খুঁজছে।
কেউ বলছে, পুকুরে পড়েছে কি না!
ভয় বাড়তে লাগল—এই বুঝি আব্বা এসে শাসন শুরু করবেন। কিছুক্ষণ পর আমরা নিজেরাই বেরিয়ে এলাম। তখন সবাই প্রচণ্ড বকাঝকা করল। বলল, ‘তোমাদের পড়াশোনার মনোযোগ নাই, গরু কিনে হাল চাষ শেখানো লাগবে!’
আমরা ভয়ে কাঁপছিলাম। ভাবছিলাম, আব্বা নিশ্চয়ই ছাড়বেন না। কিন্তু আশ্চর্যভাবে সেদিন তিনি কিছুই বললেন না। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম।
কিন্তু সেই রাতেই আব্বা তার বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে ঠিক করলেন, নিজেই একটি কেজি স্কুল খুলবেন। সেটিই বাস্তবায়ন করেন তিনি। আজ বুঝি, আমাদের সেই একদিনের স্কুলভীতি থেকেই স্কুলটির জন্ম হয়েছিল। আর আব্বা ছিলেন সেই শক্ত মানুষের আবরণে নরমতম হৃদয়।”
মুন্তাসির শেষ করেন এই কথাগুলো দিয়ে:
“অভাব, অভিযোগ বা অনুযোগ—অনেক কথাই তাকে বলা হয়। কিন্তু আরও কথা থেকে যায়।
যা বলব বলব করে কখনোই বলা হয়ে ওঠে না। কিছুটা অভিমানে, মধ্যবিত্তের সংকোচে, বাকিটা গোপনে— সেই কথাগুলো থেকে যায় নিজের ভেতরে!
ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় বলা হয়ে ওঠে না আব্বার প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা কিংবা মুগ্ধতার কথা। দূর থেকে তোমাকে অনেক অনূভব করি আব্বা। হয়তো তোমার প্রার্থনার কারণেই আমার জীবনে বড় কোনো বিপদ আসেনি কখনো।
তোমার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি, আব্বা। যেন শেষ সময়টা আরেকটু মসৃণ দেখে যেতে পারো।”